ঢাকা,সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়জয়কার

চকরিয়া-পেকুয়ায় নৌকার লজ্জাজনক ভরাডুবিতে আ.লীগ নেতারা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলায় তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে নৌকার লজ্জাজনক ভরাডুবি হয়েছে আ.লীগ নেতাদের। গত ২৬ ডিসেম্বর ও ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত চকরিয়া-পেকুয়া ২৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এতে চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি নৌকা, বিদ্রোহী ৪টি, স্বতন্ত্র ৫টি এবং পেকুয়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে নৌকা ২টি, বিদ্রোহী ১টি ও স্বতন্ত্র ৩টি জয়ী হয়েছেন। এরমধ্যে বারবাকিয়া ইউনিয়নের ১টি ওয়ার্ডে ভোট স্থগিত থাকায় ওই ইউনিয়নের ফলাফল পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, নানা আতঙ্ক ছাপিয়ে শেষ হয় চকরিয়া-পেকুয়া ২৫টি ইউপি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। স্থানীয় এমপি ও জেলা-উপজেলার শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও বলয়-ভিত্তিক রাজনীতির কারণে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে বলে জানান দলীয় নেতাকর্মী ও প্রার্থীরা।

এসব বেশিরভাগ ইউপিতে জয়লাভ করেছেন দলটির বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। নিবার্চনে দলীয় বিদ্রোহী নেপথ্যে হওয়ার পেছনে কাজ করেছেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাংসদ জাফর আলম বলে দাবী করেছেন তারা। তার সমর্থনের কারণে নৌকার প্রার্থী, সমর্থকরা প্রচারণা ও ভোটের মাঠে কোণঠাসা ছিলেন বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও নৌকার প্রার্থীরা।

এদিকে নৌকার ভরাডুবিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে সমালোচনার ঝড়। ‘কেন পরাজয় ঘটলো আওয়ামী লীগের’ সেই জল্পনা চলছে জেলা জুড়ে।

চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলায় নৌকার ভরাডুবি কেন? রাজনৈতিক কোন্দল? নাকি অন্য কিছু? স্থানীয়দের মতে ‘দুর্বল প্রার্থীদের মনোনয়ন এবং দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে না থেকে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ নিরব থাকা, এই দুই কারণেই শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে নৌকার প্রার্থীদের। তবে অধিকাংশ প্রার্থীদের দাবী স্থানীয় সাংসদ জাফর আলমের কারণে নৌকার পরাজয় হয়েছে। না হলে চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা, কৈয়ারবিল ও মগনামা ইউপি নির্বাচনে নৌকার মনোনীত প্রার্থীরা রেকর্ড সংখ্যক কম ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।

জানা যায়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে চকরিয়ার ১০টি ও পেকুয়ার ৬টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে নৌকার জয় হয়েছে ৫টি, বিদ্রোহী ২টি ও ৩টি স্বতন্ত্র। একইভাবে পেকুয়া ৭টির মধ্যে নৌকা ২টি, ১টি বিদ্রোহী, স্বতন্ত্র ২টি ও বারবাকিয়া ইউপির ১টি ওয়ার্ড স্থগিত রয়েছে।
কোনখালী ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন জাফর আলম ছিদ্দিকী। সেখানে নির্বাচিত হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দিদারুল হক সিকদার। একইভাবে সাহারবিল ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন মাতামুহুরী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিন বাবুল। সেখানে স্থানীয় সাংসদের ঘনিষ্টজন নবী হোসেন চৌধুরী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

খুটাখালী ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বেলাল আজাদ। সেখানে নির্বাচিত হয়েছেন জামায়াত সমর্থিত আব্দুর রহমান। ডুলাহাজারা ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা আ.লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহনেওয়াজ তালকুদার। ওই ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছেন স্থানীয় সাংসদের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারি বিদ্রোহী প্রার্থী হাসানুল ইসলাম আদর।

চিরিঙ্গা ইউপিতে মনোনয়ন পেয়েছেন ইউনিয়ন আ.লীগের সহ-সভাপতি শাহনেওয়াজ রুমেল। ওই ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছেন স্থানীয় সাংসদের নিকতম আত্মীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থী জামাল হোসেন চৌধুরী। কাকারা ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত ওসমান। সেখানে জয় পেয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক সাহাব উদ্দিন।

কৈয়ারবিল ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক জন্নাতুল বকেয়া রেখা। ওই ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছেন স্থানীয় সাংসদের অনুসারী যুবলীগ নেতা মক্কী ইকবাল হোসেন।

বরইতলী ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আ.লীগের সদস্য জিয়া উদ্দিন চৌধুরী। সেখানে নির্বাচিত হয়েছেন জামায়াত সমর্থিত ছালেকুজজামান।

অপরদিকে, পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন নাজিম উদ্দিন। এ ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ইউনুছ চৌধুরী। উজানটিয়া ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন শহীদুল ইসলাম চৌধুরী। এ ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছেন ইউনিয়ন আ.লীগের স্থানীয় সাংসদের অনুসারী বিদ্রোহী প্রার্থী তোফাজ্জল করিম।

পেকুয়া সদরে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা আ.লীগের সহ-সভাপতি সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম। সেখানে বিএনপির সভাপতি বাহাদুর শাহ নির্বাচিত হয়েছেন।

শীলখালীতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন কাজীউল ইনসান। এ ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী কামাল হোসেন।

বরইতলী ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থী এটিএম জিয়া উদ্দিন চৌধুরী জিয়া বলেন, বরইতলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী নৌকাকে হারাতে কলকাঠি নেড়েছেন। কিছু আওয়ামী লীগ লোক দেখানো আমার মিটিং-মিছিলে এসেছেন। কিন্তু তলেতলে তারাও নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন।

জামায়াত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. ছালেকুজ্জামানকে জেতাতে ভোটের আগেরদিন রাতে শান্তিবাজার এলাকায় এক সাংসদ টাকা বিলি করার সময় নেতাকর্মীরা ধাওয়া করেছে। তাছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও জামায়াতের প্রার্থীকে বিজয় করতে ভুমিকা রেখেছেন।

সাহারবিল ইউপির নৌকার প্রার্থী মহসিন বাবুল বলেন, নৌকাকে পরাজিত করতে মরিয়া হয়ে কাজ করেছেন স্থানীয় অনেক আ.লীগনেতারা। স্বতন্ত্র প্রার্থী নবী হোসেনকে জেতাতে ঘরে ঘরে টাকা বিলি করেছেন। নেতাকর্মীদের হুমকিও দিয়েছেন।

ডুলাহাজারা ইউপির নৌকার প্রার্থী শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, যে কোন নির্বাচনে ডুলাহাজারা ইউনিয়নে প্রায় ৫-৬ হাজার ভোট পেয়ে থাকে নৌকা প্রতীক। ওই নির্বাচনে স্থানীয় সাংসদের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারি হাসানুল ইসলাম আদরকে প্রার্থী করিয়েছেন। তাকে জেতানোর জন্য প্রশাসনকে নগ্নভাবে ব্যবহার করেছেন।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় নেতাকর্মীরা নৌকার পক্ষে কাজ করেনি।

খুটাখালীর ইউপির নৌকার প্রার্থী বেলাল আজাদ বলেন, খুটাখালীতে ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রথমে নৌকার পক্ষে থাকলে ভোটের আগে সরে গেছেন। তারা কৌশলে জামায়াতের প্রার্থীকে বিজয় করতে ভূমিকা রেখেছেন।

কৈয়ারবিল ইউপির নৌকার প্রার্থী জন্নাতুল বকেয়া রেখা বলেন, আমার ইউনিয়নে নৌকা প্রতীককে দু:খজনকভাবে পরাজিত করা হয়েছে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা নৌকার মনোনয়ন চাননি। নৌকার ইজ্জত বাঁচাতে আমি নৌকার মনোনয়ন চাইলে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দেন। নৌকা নিয়ে এলাকায় আসলে নৌকাকে পরাজিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি/সম্পাদসহ সিনিয়র নেতারা। শেষ পর্যন্ত পরাজিত করেছে।

পেকুয়া সদর ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থী সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম বলেন, সদর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের জয়ের সম্ভাবনা থাকলেও স্থানীয় সাংসদ ও পেকুয়া উপজেলা আ.লীগের সিনিয়র নেতাদের কারণে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। সেখানে বিএনপির প্রার্থীকে জেতানোর জন্য নগ্নভাবে প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়েছে। তথ্য: দৈনিক কক্সবাজার।

পাঠকের মতামত: